বাংলাদেশের রাজনীতি একটি নতুন সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পলায়ন আওয়ামী লীগকে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে। শুধু শেখ হাসিনা নয়, সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রধান সারির সব নেতাই হয় দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন অথবা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন।
বিশ্বের নানা দেশেই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়, কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের প্রায় সব প্রথম সারির নেতা এবং সরকারের নিয়োগ করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের একসঙ্গে এমন পতন বিশ্বের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। এ ঘটনা ইঙ্গিত দেয় যে সাবেক ক্ষমতাসীন দল কী পর্যায়ের এবং কী বিস্তৃতি নিয়ে দলীয়করণ করেছিল এবং কীভাবে সরাসরি সরকারি কর্মকর্তাদের দলীয় আনুগত্যবাহী হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
পরবর্তী সময়ের বাস্তবতায় বাংলাদেশ যেমন নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, মব-সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে, তেমনি নতুন কিছু সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিতা, বিদ্যায়তনিক, সাংস্কৃতিক ও সুশীল সমাজে নতুন ধরনের বিন্যাস লক্ষ করা যাচ্ছে। পুরোনো আওয়ামী লীগনির্ভর ব্যবস্থা ভেঙে নতুন করে ইতিহাস পর্যালোচনা ও সমাজ বিশ্লেষণের প্রবণতাও আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে ঐকমত্য তৈরির যে চেষ্টা আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা নিশ্চয়ই ইতিবাচক।
বিএনপি ২০ হাজার কিলোমিটার খাল খনন ও নদী ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়েছে। আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়েও বিশদ কার্যক্রম নেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি পরিকল্পনায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নকে বিবেচনায় রাখা হয়েছে। আগুনে ও বিভিন্ন দুর্যোগে প্রাণহানি কমাতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়েও বিশেষজ্ঞদের পরিকল্পনামাফিক এগোতে চায় বিএনপি। পরিবেশের মতো স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও কৃষিকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
অবশ্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে কিছু দলের বারবার বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। জুলাই সনদে স্বাক্ষর না দিতে চাওয়ার ফলে সে বিভেদ নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এসব অনৈক্যকে বিবেচনায় রেখেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ ও মতের পার্থক্যকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাকে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও সহিংসতার ইতিহাস। এ দেশের রাজনৈতিক সহিংসতার একটি বড় কারণ নির্বাচনের পদ্ধতি-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে তীব্র দ্বিমত ও ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার প্রবণতা। আওয়ামী লীগের শাসন পতনের পরে যে রাজনৈতিক দলগুলো এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে, তারা সবাই এ বিষয়ে একমত হয়েছে যে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাই পরবর্তী বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে।
একজন ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বের সর্বোচ্চ সময়সীমা নির্ধারণ, উচ্চকক্ষ প্রবর্তনসহ বিচার বিভাগ, পুলিশ, মিডিয়া, নির্বাচন কমিশনবিষয়ক সংস্কারসহ মোটাদাগে একটি বড় সংখ্যার সংস্কার প্রস্তাবে সব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে।
এই ঐকমত্য তৈরির পেছনে বড় দল এবং সামনের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের জন্য সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় দল বিএনপির একটি বড় অবদান রয়েছে বলে আমি মনে করি। যেসব দলের ক্ষমতায় যাওয়ার এবং রাষ্ট্র পরিচালনা করার সম্ভাবনা কম, তাদের সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হওয়া এবং বিএনপির একমত হওয়া নীতিগতভাবে একই, কিন্তু দায়িত্বশীলতার দিক থেকে ভিন্ন। কারণ, এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের যে দায়িত্ব, তা পরবর্তী সরকারের ঘাড়েই পড়বে। সেই দায়িত্বশীলতার বিবেচনায় বিএনপির বেশির ভাগ সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হওয়া শুধু কাগজে-কলমে নয়, দলটির পরিচালনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিবিসি বাংলায় প্রচারিত সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকার এবং গত কয়েক বছরে দেওয়া নানা বক্তব্য এই নতুন রাজনীতির ইঙ্গিতকে স্পষ্ট করে। সাক্ষাৎকারে তারেক রহমানের বক্তব্যের প্রাজ্ঞতা, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক দৃঢ়তা এবং দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ধারণা বেশ প্রশংসিত ও আলোচিত হয়েছে।
কিন্তু তাঁর সাম্প্রতিক সময়ের বক্তব্যে একটি বিষয় বারবার উঠে আসে, যা বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হলেও খুব বেশি আলোচনায় আসেনি। এ বিষয়টি হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে বিভেদ, রাজপথের পেশিশক্তি ও সহিংসতার বদলে নীতিভিত্তিক রাজনীতির দিকে জোর দেওয়া। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে নীতিভিত্তিক, গতানুগতিক রাজনীতির শক্তি প্রদর্শনীভিত্তিক নয়।
এই নীতিভিত্তিক নতুন রাজনীতির জন্য তৈরি হতে তারেক রহমানের উৎসাহে এবং নির্দেশনায় বিএনপির মধ্যে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি বিশেষজ্ঞনির্ভর দল তৈরি করা হয়েছে, যারা জনগণের মৌলিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছে এবং ক্ষমতায় এলে কীভাবে সেসব সমস্যার সমাধান করতে হবে, তার উপায় খুঁজে বের করতে চেষ্টা করছে। প্রথম পর্যায়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, কৃষি, সুনীল অর্থনীতি ও নতুন চাকরির সম্ভাবনা তৈরি নিয়ে বিশেষজ্ঞ দল তাদের প্রস্তাব তৈরি করেছে।
এখানে উল্লেখ্য, সাধারণ নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে এই নীতি পরিকল্পনার পার্থক্য রয়েছে। নির্বাচনের ইশতেহারে শুধু সংক্ষিপ্ত প্রতিশ্রুতি থাকে, কিন্তু এই নীতি পরিকল্পনায় বিশদ বর্ণনা থাকছে, যেখানে একটি পরিকল্পনা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, তার খুঁটিনাটিও ভোটাররা জানতে পারবেন। পরিবেশকে উদাহরণ হিসেবে ধরলে বলা যায়, তারেক রহমানের প্রতিশ্রুত ২৫ কোটি গাছ লাগানো ও খাল খননের কথা। এই পলিসি টিম ২৫ কোটি গাছ কোথায়, কখন, কীভাবে লাগানো হবে তা–ই শুধু নয়, এই বৃক্ষরোপণকে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে লালন–পালনের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনাও করা হয়েছে।
বিএনপি ২০ হাজার কিলোমিটার খাল খনন ও নদী ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়েছে। আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়েও বিশদ কার্যক্রম নেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি পরিকল্পনায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নকে বিবেচনায় রাখা হয়েছে। আগুনে ও বিভিন্ন দুর্যোগে প্রাণহানি কমাতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়েও বিশেষজ্ঞদের পরিকল্পনামাফিক এগোতে চায় বিএনপি। পরিবেশের মতো স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও কৃষিকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
এই নতুন রাজনীতি ও উন্নয়নের একটি বিশেষ দিক হচ্ছে দৃশ্যমান লোক দেখানো উন্নয়নের চেয়ে, মেগা প্রজেক্টের চেয়ে সাধারণ জনগণের জীবনমান উন্নয়নের দিকে জোর দেওয়া। রাজনীতিকে নীতিনির্ভর করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা অর্থাৎ এই উন্নয়নের ফলে দেশের ধনী-গরিব সবাই উপকৃত হবেন। উন্নয়ন শুধু একটি শ্রেণি ও একটি দলের জন্য সীমাবদ্ধ থাকবে না।
গতানুগতিক সহিংস আন্দোলন ও শক্তির প্রদর্শনীর রাজনীতির বাইরে এসে নীতির প্রতিদ্বন্দ্বিতার রাজনীতি বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোয় পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। বিএনপির মতো অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও যদি তাদের নিজেদের প্রতিশ্রুত পলিসিগুলো বিশদভাবে জনগণের সামনে উপস্থাপন করে, তবে জনগণ বেছে নিতে পারবে কোন রাজনৈতিক দলের নীতি তাদের পছন্দের। গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী বেশির ভাগ দেশেরই রাজনীতির প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গাটি নীতি নিয়েই হয়, বাংলাদেশেও সেই যাত্রা শুরু হোক।
মতামত লেখকের নিজস্ব
সংবাদসূত্র : প্রথম আলো অনলাইন।